উদ্বাস্তু রোহিঙ্গারা এখন মূর্তিমান আতঙ্ক: ৪ বছরে এক হাজার ২৯৮ মামলা

বিশেষ প্রতিনিধি •

দেশে ফেরার দাবিতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ (ফাইল ছবি)

২০১৭ সালে মিয়ানমারে গণহত্যার মুখে দেশ ছেড়ে দলে দলে রোহিঙ্গা কক্সবাজার সীমান্ত হয়ে বাংলাদেশে ঢোকে। সে সময় প্রায় ৭ লাখ লোককে ঠাঁই দেওয়ায় নতুন এক মানবিক বাংলাদেশকে চিনলো বিশ্ব। কিন্তু মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেওয়া এই রোহিঙ্গারাই এখন এ দেশের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তারা জড়িয়ে পড়েছে খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। আর কক্সবাজারবাসীর কাছে এখন রোহিঙ্গারা মূর্তিমান আতঙ্ক।

বিগত ৪ বছরে জেলায় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডাকাতি বা ডাকাতির প্রস্তুতি, হত্যা, মানব পাচারসহ ১২ ধরনের অপরাধে ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ৭০টি খুন, ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানবপাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ, ১০টি ডাকাতি এবং ৩৪টি অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের মামলা ও অন্যান্য আইনে ৮৯টি মামলা উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ৭৬টি।

আর এসব মামলায় আসামি করা হয় ১৫৯ জনকে। ২০১৮ সালে ২০৮ মামলায় আসামি ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৬৩টি। আর এসব মামলায় আসামি ৬৪৯ জন। ২০২০ সালে ১৮৪ মামলায় ৪৪৯ রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৫৬৭টি মামলায় ১ হাজারের ওপরে রোহিঙ্গা অভিযুক্ত হয়েছে।

অর্থলোভে ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে গড়ে উঠেছে একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী। প্রতিনিয়িত সেখানে এসব বাহিনীর হাতে খুন, অপহরণের ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে টেকনাফ লেদা ক্যাম্পের রোহিঙ্গা আবদু শুক্কুর বলেন, টাকার লোভে কিছু রোহিঙ্গা মাদক ও অস্ত্রপাচার, স্বর্ণ চোরাচালান, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও খুনের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে।

রোহিঙ্গাদের অপরাধ কার্যক্রম কেবল ক্যাম্পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। তারা মুক্তিপণের জন্য প্রায়ই স্থানীয়দের অপহরণ করছে । ফলে জেলাবাসীর কাছে এখন মূর্তিমান আতঙ্ক এই উদ্বাস্তুরা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটা অংশকে সরকার ভাসানচরে স্থানান্তরের চেষ্টা করলেও তারা সেখান থেকেও পালিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে।

বাহারছড়া ইউপি চেয়ারম্যান মৌলভী আজিজ উদ্দিন বলেন, মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়া রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের কাছে এক আতঙ্কের নাম। তারা প্রতিনিয়ত মাদক ও মানবপাচার, অবৈধ অস্ত্র ও স্বর্ণের চোরকারবার, অপহরণ, খুন প্রভৃতি নানা অপকর্ম করে যাচ্ছে। এরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। এক্ষুনি যদি উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত ১৩ লাখ রোহিঙ্গার লাগাম টেনে ধরা না যায়, তবে স্থানীয়দের পরবাসী হয়ে থাকতে হবে ভবিষ্যতে।

কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহাবুবুর রহমান বলেন, জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য রোহিঙ্গারা দায়ী। জেলায় যে পরিমাণ অপরাধ এখন হচ্ছে, তা অতীতে কখনও হয়নি। রোহিঙ্গারা ভাড়াটে খুনি, অপহরণকারী হিসেবেও কাজ করছে। সম্প্রতি উখিয়া ও টেকনাফে দু’টি হত্যাকাণ্ড তাদের হাতে সংঘটিত হয়েছে। একসময় মানবিক কারণে এই উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিলেও, এখন এদের কারণে নিজেদের অনিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে স্থানীয়রা।

কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা নানাভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। এখনও যদি লাগাম টেনে ধরা না হয়, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ দুরূহ হয়ে পড়বে।

তিনি আরও বলেন, দ্রুত এদেরকে মিয়ানমার ফেরত পাঠানো দরকার।

রোহিঙ্গাদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা কাজ করছে জানিয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে জেলা পুলিশের পাশাপাশি ক্যাম্পে এপিবিএনের তিনটি ব্যাটালিয়ন কাজ করছে। পাশাপাশি র‌্যাব আর গোয়েন্দা পুলিশও আছে।

আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর কড়া নজরদারি সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা বেড়েই চলেছে- এমনটা জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী বলেন, প্রতিদিনই নতুন নতুন রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। এর ফলে তাদের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে তাদের অপরাধ প্রবণতা। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে তারা ক্যাম্পের বাইরে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। গঠিত হচ্ছে নিত্যনতুন সন্ত্রাসী বাহিনী।

তিনি আরও বলেন, তুচ্ছ কারণে যেভাবে এরা নিজেদের খুন-খারাবি করে, তেমনি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মাঝেও ভীতি সঞ্চারের চেষ্টা চালায়। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর আইন প্রয়োগের পক্ষে।